আইরিশ ভিসা পেয়ে গেলাম। এরপর কী হলো?

সত্যিই ভাবিনি এত দ্রুত ভিসা হয়ে যাবে আমার। সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ ভিসা থিং-এ আমার সকল পেপার সাবমিট করলাম। মাঝে সরকারী ছুটি থাকার কারণে ভিসা থিং-এর পোর্টালে দেখলাম এখনও আমার কাগজপত্র দিল্লী এম্বাসিতে পৌঁছায়নি। তারপর ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ আমার পেপারস দিল্লী আইরিশ এম্বাসিতে পৌঁছায় এবং অপেক্ষার পালা শুরু হয়ে গেল আমার। 

৬ অক্টোবর ২০২২ বিকাল ৫ টায় ইএসসিবির ল্যাবে বসেছিলাম। হঠাৎ দেখি ইমেইলের নোটিফিকেশন। খুলে দেখি পাসপোর্ট কালেকশনের রিকুয়েস্ট দিল্লী এম্বাসি থেকে। তারা ইমেইলে লিখেছে যদি ভিসা ডিসিশন চেক করতে চাই তাহলে এই লিঙ্কে গিয়ে যেন দেখি। লিঙ্কটা ওপেন করলাম এবং দেখলাম আমার আবেদনের নাম্বারটার পাশে ভিসা ডিসিশন পিএইচডি স্টাডি এপ্রুভড। এবার পাসপোর্ট কালেকশনের পালা। আবার অপেক্ষার শুরু কারণ আমার হাতে তো কিছুই নেই। ভিসা থিং-এর মাধ্যমে পাসপোর্ট কালেক্ট করতে হবে। তাদেরকে জানালাম পাসপোর্ট কালেকশনের ইমেইলের কথা। তারা সাথে সাথেই তাদের দিল্লী হাবে আমার ইমেইলটা ফরোয়ার্ড করে দিলেন। ৬ অক্টোবর পাসপোর্ট কালেকশনের ইমেইল পেলেও সেই পাসপোর্ট হাতে পেলাম আমি ১৬ অক্টোবর ২০২২। 

যাক এক যুদ্ধ শেষ হলো, কিন্তু শুরু হলো নতুন যুদ্ধ। কী? সবাই মানে যারা আমার আশেপাশে বিদেশ ঘোরা অভিজ্ঞ ব্যক্তি আছেন তারা বলছিল আমার এই মুহূর্তেই টিকিট কনফার্ম করা উচিত। যেহেতু ভিসা হয়ে গেছে। তাহলে টিকিট করতে আর দেরি কেন? কারণ টিকিট যত আগে কাটবো তত দামে সাশ্রয়ী পাব। ঘটনা আসলেই সত্যি। কিন্তু হায়! আমি কারো কথা মতই টিকিট কনফার্ম করতে গেলাম না। দামের সাশ্রয়ীর কথা ভুলেই গেলাম। কিন্তু দেখতে লাগলাম সম্ভাব্য তারিখে টিকিটের দাম আসলে কত পড়ে? তো দেখলাম টিকিটের মূল্য একদম আকাশচুম্বী। মানে মধ্যবিত্তদের একদম নাগালের বাইরেই বলা চলে। জানি না হয়তো আমি বিদেশে পড়তে যেতে চাচ্ছি বলেই কিনা ডলারের দাম এত বেড়েছে বর্তমানে!

সব জেনেও আমি টিকিট কনফার্ম করলাম না। কেন? সে আরেক ইতিহাস। আমি যে টিকিট কনফার্ম করে আয়ারল্যান্ড যাব কিন্তু থাকবো কোথায়?? কাজেই আমার কাছে মনে হয়েছে আগে থাকার জায়গা কনফার্ম করা জরুরী। তারপর টিকিট কনফার্ম।

আশেপাশে পরিচিত সবাইকে নক দিলাম যারা ইতোমধ্যে আয়ারল্যান্ডে আছেন। সবার এক কথা "আয়ারল্যান্ডে বাসা খুঁজে পাওয়ার থেকে চাকরি খুঁজে পাওয়া সহজ"। অনলাইনে দুইটা সাইট daft.ie এবং rent.ie তন্য তন্য করে খোঁজা শুরু করলাম। বাড়িওয়ালাদেরকে ইমেইল করলাম। যাদের ফোন নাম্বার দেয়া আছে তাদেরকে Whatsapp এ নক দিলাম। কেউ রিপ্লাই দেয় তো কেউ দেয় না এরকম অবস্থা! আবার ইউনিভার্সিটি অব লিমেরিক থেকে দূরত্বও দেখতে হয় গুগল থেকে। যে বাসা পাই তা অনেক দূর দূরান্তে। অচেনা জায়গা এমনিতেই দূর লাগে। তারমধ্যে যখন দেখি গুগল দেখায় বাসে যেতে ১ ঘণ্টা লাগবে তখন আমি বাংলাদেশে বসে থেকে পথ মেলানোর চেষ্টা করি। ১ ঘণ্টা দূরত্ব তো তাহলে মগবাজার থেকে গুলশান হবে এরকম বুঝি! 

যাই হোক, এভাবে শুধু খুঁজেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু ভাবিনি সামনে যে মস্ত বড় এক বাঁধা রয়েই গেছে। বাসা পেলাম কিন্তু আয়ারল্যান্ডের নিয়ম হচ্ছে বাসা নেয়ার আগে ডিপোজিট করতে হবে। তো এই ডিপোজিটের টাকা বাংলাদেশ থেকে পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানেও হন্যে হয়ে খুঁজেও সঠিক কোনো মাধ্যম পেলাম না বাংলাদেশ থেকে টাকা পাঠানোর। এখানে কেউ কেউ বলে থাকবেন যে আছে মাধ্যম। কিন্তু ওটা আসলে সবার জন্যে না। যেমনঃ আপনি যদি বিকাশে টাকা পাঠাতে চান কাউকে তাহলে তারও বিকাশ একাউন্ট লাগবে, নাকি? 

তো অবস্থা যখন এমন বেগতিক তখন আমি আর এত ঝক্কি ঝামেলা নিতে পারছি না। কী করবো? কী করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছি না। কতবার মনেও হয়েছে কেন আমি এই পাতাল মহাসাগরে ঝাপ দিতে আগ্রহী হয়েছিলাম। যাই হোক, সবাই পরামর্শ দিচ্ছে আমার টিকিট কনফার্ম করে আয়ারল্যান্ড গিয়ে হোটেলে থেকে বাসা খুঁজে নিতে। যেটা আমি বা আমার পরিবার কেউই মেনে নিতে পারিনি। কারণ বলা যত সহজ করা তত কঠিন। কাজেই হোটেলে আমি কয়দিন থাকবো? আর হোটেলের যা খরচ তা দেয়ার সামর্থ্যও আমার বা আমার পরিবারের নেই। কাজেই কাছের মানুষদের এই কথাটাও আমি রাখতে পারলাম না ঠিক টিকিট কনফার্মের মতই। 

পাওলো কোহেলহোর একটা উক্তি না লিখে পারছি না-- যখন তুমি মন থেকে কিছু চাও, পুরো বিশ্ব তা পেতে তোমাকে সাহায্য করবে। সত্যিই তাই।

বাসা খুঁজে না পেলেও বাড়িওয়ালাকে কীভাবে টাকা পাঠাতে পারি সেই ব্যবস্থা হল। আমার তানিয়া ফুপি কানাডা থাকে। সে বলেছে তুমি বাসা দেখো আমি ডাউনপেমেন্ট করে দেব। যাক আলহামদুলিল্লাহ্‌।

এরপর যার কথা লিখতেই হবে। সে না থাকলে বাসা কীভাবে খুঁজে পেতাম সে আল্লাহ জানে। আসলে আল্লাহই সব ব্যবস্থা করে রাখেন। শোভনী আপু যার সাথে খুব অল্প দিনের পরিচয় সেটাও ফেইসবুকে। সেই আপু বিশাল বড় দায়িত্ব নিলেন এবং আমার কঠিন মুহূর্তে আশীর্বাদ হয়ে এলেন। সাথে নন্দিতা আপুও ভীষণ সাপোর্ট দিলেন বিপদের মুহূর্তে। আমিও তাদেরকে এটা সেটা নানা প্রশ্নে জর্জরিত করে রাখলাম বাসা পাওয়ার আগ পর্যন্ত। তারা একটুও বিরক্ত হয়নি। তারপর শোভনী আপুর হাজবেন্ডের কলিগের বাসায় একটা রুম পাওয়া গেছে। যদিও দূরত্বের জন্যে প্রথমে মানা করেছিলাম কারণ বাসে যেতেই ১ ঘণ্টা লাগবে বাসা টু ভার্সিটি। আমি খুঁজছিলাম ভার্সিটির কাছাকাছি কোনো বাসা তাতে করে পায়ে হেঁটেই ভার্সিটি যেতে পারবো, কিন্তু পেলাম না। নিরুপায় হয়ে শোভনী আপুকে বললাম ঐ বাসাতেই উঠবো। তারপর ৬০০ ইউরো শোভনী আপুর হাজবেন্ড তার কলিগকে আমার হয়ে দিয়ে দেয় অর্থাৎ ডিপোজিট করে দেয়। আপু কোনো রকম প্রত্যাশা ছাড়াই আমার জন্যে এত কিছু করেছে আমার এই আয়ারল্যান্ড যাত্রায়। ঋণ শোধ করতে না পারলেও তার ঋণ স্বীকার করি। 

যে বাসাটা পেলাম এটা আসলে একটা হিন্দু ফ্যামিলির সাথে শেয়ারিং এ থাকতে হবে। শুধু তাই না এই ফ্যামিলি নিরামিষভোজী। তারা মাংস খায় না একদমই। সব জেনেও নিলাম কারণ এছাড়া কোনো অপশন নেই আমার। 

তারপর এবার টিকিট কনফার্মের পালা। এখানেও কাহিনীর শেষ নেই। ডলারের দাম বাড়াতে ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলা সেই সুযোগ নিচ্ছে। একেকজনে একেক মূল্য নির্ধারিত করে রেখেছে। কে ভাল আর কে খারাপ কিছুই জানি না। আমার তো এখানেও কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কোন এজেন্টের কাছ থেকে টিকিট নেয়া ভাল বুঝতে পারছি না। আবার এজেন্টরা বলছে অনলাইনে টিকিট কনফার্ম করলে দাম কম পড়বে কিন্তু সরাসরি তাদের অফিসে গিয়ে কাটলে দাম বেশি পড়বে। নিয়াজ ভাইয়াকে এই ঘটনা বললাম, ভাইয়া শুনে বলল, ঢাকাতে অনেক বড় বড় এয়ারলাইন্সের অফিস আছে তুমি সেখানে গিয়ে টিকিট কনফার্ম করো। 

তারপর অক্টোবরের ২৭ তারিখ টিকিট কনফার্ম করি। এমিরাত এয়ারলাইন্সের গুলশান অফিস থেকে। টিকিটের মূল্য এক লক্ষ বারো হাজার নয়শত টাকা মাত্র। ভাবলাম টাকার কোনোই মূল্য নাই। যাই হোক ফ্লাইট ছিল ১২-ই নভেম্বর রাত ১ টা অর্থাৎ বাসা থেকে বের হতে হবে ১১ তারিখ সন্ধ্যায় কারণ এয়ারপোর্টে চেক ইনের জন্যে থাকতে হবে রাত ৯ টায়। 

টিকিট কনফার্ম করার পর থেকে শুরু হলো কেনাকাটা। সে আরেক অধ্যায়। কী নিতে হবে? কী নেয়া উচিত? কিছুই মাথায় আসছে না বা জানি না। তারপর একটা চেক লিস্ট তৈরি করলাম এবং একদম ফ্লাইটের দিন পর্যন্ত টুকটাক টুকটাক করে একজন মানুষের চলার জন্যে যা লাগে সবই নিলাম। ইন ফ্যাক্ট, আমার আম্মু বলতো যে এতদিনের জন্যে দেশ ছেড়ে যাব তাই কোথায় একটু বাসায় বসে আরাম করবো, কিন্তু না প্রতিদিনই নিয়ম করে বের হতে হয়। শুধু তাই না আমাকে সব গুছিয়ে দেয়ার জন্যে বাড়ির প্রত্যেকটা লোক কোনো না কোনো কিছু কিনতে বের হচ্ছে। একদিকে আমি যাই ভাইয়াকে নিয়ে এক কাজ করতে আর অন্যদিকে আব্বু আম্মু যায় অন্য কিছু কিনতে। একদম হুলুস্থুল অবস্থা! তারপরও মনে হতে লাগল আয়ারল্যান্ড পৌঁছানোর পর মনে হবে এইটা না আনলেও হত বা এইটা না এনে যদি ঐটা আনতাম।

কাপড়-চোপড় ব্যাগ-ব্যাগেজ কেনাকাটা আমার আর ভাইয়ার উপর। ওদিকে রান্না করার মশলা, সরিষার তৈল, শুকনা খাবার জিনিস, এমন কি মোটামুটি ২/৩ দিন চলার জন্যে চাল,আলু, কাঁচামরিচ সবই আমার আম্মু আমাকে গুছিয়ে দিয়েছে। তারপর চা খাওয়ার জন্যে গুঁড়া দুধ, ইস্পাহানী টী ব্যাগ সবই দিয়েছে। এছাড়া মেডিসিন, চশমা, বেড শীট ইত্যাদি। আম্মু-আব্বু-ভাইয়া না থাকলে আমি এইসব গুছিয়ে কখনোই আসতে পারতাম না এই অচেনা দেশে। লিখতে গিয়েও চোখ ভিজে যাচ্ছে এই ভেবে যে দকল শুধু আমার উপর দিয়েই যায়নি, আমার কাছের মানুষদের উপর দিয়েও সেই দকল গেছে। 

তারপর শেষ ঝামেলা হয়েছিল বাংলা টাকাকে ইউরো করা নিয়ে। ফ্লাইটের ৭ দিন আগে ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম খোঁজ নিতে যে কী করে ইউরো করে বা কত ইউরো ব্যাংক থেকে দেয়। তো গেলাম ব্র্যাক ব্যাঙ্কে তারা  বলল সর্বোচ্চ ২০০ ইউরো দিয়ে থাকে তারা তবে সেটা মেইন ব্রাঞ্চ থেকে নিতে হয়। আমি গিয়েছিলাম মগবাজার ব্রাঞ্চে। তো এভাবে কয়েকটা ব্যাঙ্ক ঘুরলাম তাতে বুঝলাম যে কোনো ব্যাঙ্কই ২০০/৩০০ ইউরোর উপরে দেয় না এবং ব্যাঙ্কে একাউন্ট থাকতে হবে, কিন্তু অত স্বল্প সময়ে ১০ টা ব্যাঙ্কে একাউন্ট ওপেন করাও সময়ের ব্যাপার। তাছাড়া আমার লাগবে ৩০০০ হাজার ইউরো। সে এক বিশাল অংক। ব্যাঙ্কে পরিচিত কেউ থাকলে বেশি ইউরো পাওয়া যায় কিনা তার জন্যে রুনা আপুর সাথে কথা বললাম এবং তার ক্লাসমেট সোনালি ব্যাঙ্কের প্রিন্সিপাল অফিসার। তার সাথে কথা বললাম কিন্তু ঐ একই কথা। শেষমেশ বুঝলাম মানি এক্সচেঞ্জারদের কাছ থেকে নেয়া ছাড়া উপায় নাই। তারপর মামার কলিগ ফকরুল মামার পরিচিত মানি এক্সচেঞ্জার অফিস মতিঝিল থেকে ৩০০০ ইউরো নেই যার দাম ৩ লক্ষ ২৯ হাজার ১ শত টাকা মাত্র। অবস্থা এমন যে বস্তা ভরে টাকা দিয়ে পেলাম এক মুঠো টাকা (ইউরো)। পার ইউরো ১০৯ টাকা ৭০ পয়সা নিয়েছিল। এরপর ব্যাঙ্ক থেকেও নিয়েছিলাম ২০০ ইউরো আরও চড়া দামে সাথে এন্ডোর্স করেছিলাম একটা সার্টিফিকেট নেয়ার জন্যে যদি এয়ারপোর্ট চেকিং- এ ধরে (এয়ারপোর্টে এ নিয়ে কোনো ঝামেলাই হয়নি)। তারপর আমি পিএইচডি স্কলারশিপ পেয়েছি সে কারণে আমার কর্নেল দাদা ভালবেসে অনেক স্নেহ দিয়ে আমাকে ৫০ হাজার টাকার একটা চেক লিখে দিয়েছিলেন। কাছের বন্ধুর থেকে ২০০ ইউরো উপহার পেয়েছিলাম। আর আমার এই পিএইচডি ভ্রমণে মামা, কর্নেল দাদা ছাড়াও আরও একজন মানুষ বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছিলেন তাদের সকলের কাছেই আমি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ। আর আমার আব্বু তার পেনশনের দুই লক্ষ টাকা আমার স্কলারশিপের ইমেইল যেদিন পাই তার কয়দিন পরেই আমার হাতে দিয়েছিলেন ভিসা-ল্যাঙ্গুয়েজ-টেস্ট-টিকিটের জন্যে। সর্বোপরি সবার সহযোগিতা ছাড়া আমি আজ এই গল্প লেখার শক্তিই পেতাম না বা লেখাই হতো না। আসলে সবই আল্লাহ নির্ধারিত করে রেখেছিলেন আমার জন্যে। আল্লাহর অশেষ রহমতের ছায়ায় আছি আমি। 

আপাতত এই ভিসা-টিকিট-ইউরোর গল্প এখানেই শেষ করছি কিন্তু ফিরে আসব বিদায়ের গল্প নিয়ে। 


No comments

Powered by Blogger.