একটু একটু করে দূরে চলে যাওয়া!

তারপর বেজে উঠলো সেই করুণ ঘণ্টা। বিদায় বেলা। জীবনে ট্রাভেলিং বলতে শুধু ঢাকা টু টাঙ্গাইল গিয়েছি। অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ বা ইচ্ছা কোনোটাই হয়নি। সেই আমি কী করে উড়োজাহাজের পেটের মধ্যে পুরে আয়ারল্যান্ড যাব এই ভাবনায় আমি শেষ। ঘুমের মধ্যেও চিন্তা হতো প্লেনের ভেতরে কী হবে আমার? প্লেন যখন টেকঅফ করবে তখন কী মাথা-টাথা ঘুরে পড়ে যাব? আবার প্লেনের টয়লেটটা কেমন হবে? টয়লেটে গেলে যদি ধপাস করে পড়ে যাই। তারপর মনে হতো যেহেতু একা এত ঘণ্টা জার্নি করবো এয়ারপোর্টে যদি সব ডকুমেন্ট হারিয়ে ফেলি বা পাসপোর্টটা হারিয়ে ফেলি। কারণ মানুষ প্রেসারে থাকলে ব্রেইন তখন ঠিকঠাক কাজ করে না। তো এরকম নানা উদ্ভট চিন্তা আমার মাথায় ঘুরপাক খেত। কিন্তু কাউকে বলতাম না। আমি জানি বাসায় কাউকে বললে তারা আরও বেশি চিন্তা করবে। কারণ তারা এভাবেই তিনগুণ বেশি চিন্তিত আমাকে নিয়ে, আমার এই দেশ ছেড়ে যাওয়া নিয়ে। 

১১ তারিখ সন্ধ্যা ৬ টার পর এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম বাসা থেকে। আমার সাথে আব্বু, ভাইয়া, ও আমার প্রিয় কাজিন রুবেল এয়ারপোর্ট গিয়েছিল। আর রাজ্জাক ভাইয়ার ফ্যামিলি এসেছিল এয়ারপোর্টে আমাকে বিদায় দিতে। এয়ারপোর্টে ভাইয়ার এক ক্লোজ ফ্রেন্ড জব করে, সেদিন ঐ সোলায়মান ভাইয়া ইমিগ্রেশনের আগ পর্যন্ত অর্থাৎ চেক-ইন পর্যন্ত আমার সাথেই ছিলেন। 

তো এয়ারপোর্টে সবাই অপেক্ষা করছি। তারপর রুবেল খাবার নিয়ে এলো। রুবেল জিজ্ঞেস করলো আমাকে কী খেতে ইচ্ছে করছে? বললাম কিছুই না, তবে চা খেতে পারি। পরে সে বাইক দিয়ে গিয়ে আমার জন্যে স্যান্ডউইচ, চা নিয়ে এসেছিল। বাংলাদেশের শেষ চা ঐ এয়ারপোর্টেই খেয়ে এসেছি। তো এরকম চা-স্যান্ডউইচ খেতে খেতে দেখলাম টিভি স্ক্রিনে আমার ফ্লাইট নাম্বার দেখাচ্ছে EK 585 Ck-in Open. তো লাগেজ ব্যাগ ট্রলিতে নিয়ে ভেতরে চলে গেলাম। 

তারপর চেক-ইনের জন্য খুঁজে বের করলাম D কাউন্টার। সেখানে লম্বা কিউ থেকে চেক-ইন শেষ করে ইমিগ্রেশনের জন্যে গেলাম। এখানে একটা কথা বলা জরুরী। আসলে একেক জনের অভিজ্ঞতা একেক রকম তাই আপনি যাকে প্রশ্ন করেছেন সে যে অভিজ্ঞতা পেয়েছে সেটাই তো বলবে নাকি? কিন্তু আপনার সাথে কিন্তু ওরকমটা নাও ঘটতে পারে। হয়তো খুব সহজেই পার হয়ে যাবেন এয়ারপোর্টের চেক-ইন থেকে শুরু করে ইমিগ্রেশন, সিকিউরিটি সব কিছুতে, অথবা ঝামেলা পোহাতে হতে পারে। তো ঝামেলার কথা ভেবে আমি আমার পাসপোর্ট, ভিসা, টিকিট, অফার লেটার ৪ সেট করে রেখেছিলাম। কারণ শুনেছিলাম এয়ারপোর্টে নাকি জায়গায় জায়গায় এইগুলা দেখতে চাইতে পারে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে আমাকে শুধু একবারই বাংলাদেশ এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট-ভিসা-অফার লেটার দেখাতে হয়েছিল। বিডি এয়ারপোর্টে এসব আর লাগেনি। আর কোনো ঝামেলার মধ্যেও পড়িনি। আলহামদুলিল্লাহ্‌! ইমিগ্রেশন অফিসার যখনই দেখেছে আমার ফুল ফান্ডিং পিএইচডি স্কলারশিপ তখনই জাস্ট ক্যামেরাতে ফেইস ক্যাপচার করে থ্যাঙ্ক ইউ বলে ছেড়ে দিয়েছে। তো সহজেই ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেলাম। 

এবার শুরু হলো এমিরাত ফ্লাইটের সিকিউরিটির জন্যে অপেক্ষার পালা। ফ্লাইট যেহেতু রাত ১ টায় কাজেই গেইট ওপেন হবে রাত ১১ টায়। টিভি স্ক্রিনে দেখাচ্ছিল EK585 Gate Open 11 am. ততক্ষণে আপনজন সবাই বাড়ি পৌঁছে গেছে এয়ারপোর্ট থেকে। আমি একা বসে আছি এক অজানার উদ্দেশ্যে। একটু পর পরই কেঁদে উঠি। আম্মু-আব্বুর কান্না মনে করে কাঁদি। তাদের মত করে তো আমার জন্যে চোখ ভাসাবে না কেউ কোনোদিন। আমি লাগেজ গুছাই আম্মু কাঁদে। আব্বু হাউ-মাউ করে কেঁদেছে। তাদের ভয় একটাই বয়স হচ্ছে শেষ সময়ে তাদের একটা সন্তান কাছে থাকবে না যদি কিছু হয়ে যায়! আর আমি কাঁদি আর ভাবি আল্লাহ যেন আমাকে এত বড় শাস্তি না দেয়। কারণ আমি নিতে পারবো না। এইসব অনুভূতি কাউকে বোঝানোও যাবে না। কী যে ফেলে যাচ্ছি এ দেশে সেটাও লিখে প্রকাশ করা যাবে না। 

তারপর এইতো দেখতে দেখতে সিকিউরিটির সময় হয়ে গেল। এখানে একটু বেশি বেশিই করে যেমনঃ আপনার ব্যাগের সব জিনিসপত্র এবং যদি ল্যাপটপ-চার্জার থাকে সব বের করে ট্রেতে রাখতে হবে। এমন কি আপনার পায়ের জুতা-মোজা সব খুলে আরেকটা ট্রেতে রেখে স্ক্যান করতে দিতে হবে। এখানেও আমার ভাগ্য ভাল যে আমাকে ব্যাগ থেকে সব বের করে দেখাতে হয়নি। শুধু ল্যাপটপ-চার্জার এক ট্রেতে দিয়েছিলাম আর জুতা দিয়েছিলাম অন্য ট্রেতে। মোজা খুলতে হয়নি আমার। তো এই সিকিউরিটি শেষে আবারও অপেক্ষার পালা যে কখন প্লেনে নেয়ার জন্যে ডাকবে। তখন মধ্যরাত হয়ে গেছে এবং যে ওয়েটিং রুমে বসেছিলাম সেখান থেকে গ্লাসের দেয়াল ভেদ করে এয়ারপোর্টের সোডিয়াম লাইটে বিশাল বড় এমিরাতের উড়োজাহাজকে দেখা যাচ্ছিল। উড়োজাহাজের পেটের ভেতর থেকে দল বেঁধে এয়ার হোস্টেজরা বেড়িয়ে আসছিল। তো চুইংগাম চিবাচ্ছিলাম আর তাদেরকে দেখছিলাম। আর ভাইয়া আম্মুর সাথে ভিডিও কলে কথা বলছিলাম। টেকনোলোজি আসলে সবকিছু হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। এটাও ভাবলাম আজ থেকে ১৫ বছর আগে এত সুবিধা ছিল না। তখনও মানুষ আপনজন ছেড়ে পড়তে যেত। বিদেশ পাড়ি দিত। আর এখন তো অনেক সহজ হয়েছে সবকিছু। তবুও কান্না হয় আপনজন ছেড়ে যেতে, আবেগে ভাসি-ডুবি। এটাই হয়তো স্বাভাবিক!  



সাড়ে বারোটায় ডাক পড়লো উড়োজাহাজের পেটের ভেতরে প্রবেশ করার। ভয়ে ভয়েই গেলাম। আসলে অত রাত তাই হয়তো এমন লেগেছিল আমার। ভেতরের লাইটও সোডিয়াম। দেখে পছন্দ হলো না। দেখেই মনে হলো পুরাই মুড়ির টিনের মত বিমান। সিট খুঁজে পেতেও কষ্ট হলো না। কারণ আমাকে সেবা দেয়ার জন্যে এয়ার হোস্টেজরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সো কোনো চিন্তা নাই। সিট নাম্বার ছিল -A27 Window Site. সিটটা দেখেও পছন্দ হলো না। কারণ একদম প্লেনের পাখার কাছে সিট দিয়েছে। এত বড় একটা বিমানের আর জানালা খুঁজে পায় নাই টিকিট কাউন্টারের ঐ ভদ্রমহিলা। মূলত একটা ভাল সিট পাওয়ার জন্যেই গুলশান এমিরাতের অফিসে গিয়ে টিকিট কনফার্ম করেছিলাম। যাক গে, এইটাও আমার ভাগ্য বলেই মেনে নিলাম। সবই আল্লাহর দান। সিটে বসার পর এক এয়ার হোস্টেজ এলো তারে বললাম এটাই আমার প্রথম আকাশে ওড়া। সে শুনে আমাকে একটা কলম গিফট করলো। এমিরাতের কলম। তারপর ব্যাগ রেখে দিলাম উপরে। সিট বেল্ট বেঁধে নিলাম। ভয়-শুন্যতা ঠিকই আমাকে খোঁচাচ্ছে ভেতরে ভেতরে! একটা সময় পর দেখি ঘোষণা করছে টেক অফের। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। কোনোকিছুই ভালো বোঝা যায় না। রাতের অন্ধকারে সব ঢেকে আছে। তো প্লেন টেকঅফের সময় যে ভয়টা আসলে লাগে সেটা হচ্ছে কিছু একটা হয়ে গেলে এখান থেকে ফেরার কোনো পথ নাই এবং যে কোনো ধরণের টেকনিক্যাল প্রবলেম তো হতেই পারে। যাক বিমান রানওয়েতে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে লিফটের মত একটু হ্যাঁচকা টানে উপরে উঠে গেল। এই সময়টাতে আসলেই টেনশন, চাপ, উত্তেজনা কাজ করে। 

তারপর প্লেনের যে জিনিসটা একদমই ভাল লাগে নাই-- সারা পথই ইঞ্জিন শব্দ করছে। বিরক্তিকর! পুরাই মুড়ির টিনের মত বিমান। কিন্তু প্লেনের খাবার ভাল ছিল এবং দুবাই যেতে ৬ ঘণ্টা লাগে। তো যা খাবার দেয় তা এই ছয় ঘণ্টা খেতে খেতেই কেটে যাবে। তবে প্লেনের কফির একদমই স্বাদ নাই। ফালতু! তারপর চাইলেই মুভি দেখা যায়, কিন্তু আমার মন ভাল ছিল না তাই দেখার ইচ্ছে হয়নি, শুধু ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখেছি মুভি, ইনফরমেশন, লোকেশন এবং বিমানের গতিপথ এইসব দেখেছি। তারপর ঘুম পেয়েছিল কারণ ক্লান্ত ছিলাম আর সাথে কান্না তো ছিলই। তো ঘুম থেকে উঠে শুনি প্লেন এখন ল্যান্ড করবে অর্থাৎ দুবাই চলে এসেছি। ভাবতেই আবার চোখটা ভিজে উঠলো। আম্মুকে মনে পড়লো। তারপর আরও বেশি অসহায় লাগলো কারণ ফোনে ইন্টারনেট নেই। কোথাও যোগাযোগ করতে পারছি না। যদিও প্লেনে wifi আছে দেখায় কিন্তু আদতে কোনো কাজের না। হুদাই! 




তারপর দুবাই ল্যান্ড করে প্রথম গেলাম সিকিউরিটির জন্যে। আগেই জেনেছিলাম যে দুবাই এয়ারপোর্ট অনেক বড়। এখানে গেইট খুঁজে পাওয়া মুশকিল এবং সময় সাপেক্ষের তাই সময় নষ্ট না করে সিকিউরিটি শেষ করেই যেন গেইটে চলে যাই। তো দুবাই সিকিউরিটি খুব কঠিন। তারা সহজে ছাড়েনি। আমার হাতের বেস্লেট পর্যন্ত খুলে সিকিউরিটি চেকিং-এ দিতে হয়েছে। পাশাপাশি ল্যাপটপ, ব্যাটারি সবই চেকিং হয়েছে। চেকিং শেষ করে টিভি স্ক্রিনে দেখলাম Flight EK-161 Gate B26. তো ডিরেকশন অনুযায়ী গেইটে চলে গেলাম। তখন ভোর ৫ টা বাজে। আমার নেক্সট ফ্লাইট সাতটা পাঁচে। তো অপেক্ষা করতে হবে। এদিকে ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম কিন্তু নেটের অবস্থা ভাল না এবং আমার ফোনেও চার্জ নেই। পাওয়ার ব্যাঙ্ক এনেছি সাথে করে কিন্তু iPhone 13 এর ইউএসবি ক্যাবল ভুলে বাসায় ফেলে এসেছি। কেমনটা লাগে? চিন্তায় পড়ে গেলাম ডাবলিন পর্যন্ত এইটুকু চার্জ নিয়ে যাব কীভাবে এবং ডাবলিন পৌঁছে শোভনী আপুর সাথে কীভাবে যোগাযোগ করবো? ঐ যে আল্লাহর অশেষ রহমত আমার সাথে আছে তাই পাশেই দেখি এক ভদ্রলোক তার ফোনে চার্জ দিচ্ছে ইউএসবি ক্যাবল দিয়ে তো তাকে অনুরোধ করলাম। সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেল এবং সেও ডাবলিন যাবে। কাজেই বলল আমি আমার ফোনের চার্জ ১০০% করেই যেন তাকে ফেরত দিই। যেহেতু আমার পাওয়ার ব্যাঙ্ক আছেই। তাই সমস্যা নেই। তারপর অপেক্ষা করতে করতে সাড়ে ছয়টা বেজে গেল এবং আবারও মুড়ির টিনের মধ্যে প্রবেশ করার অনুমতি পেলাম। 

এই দুবাই থেকে ডাবলিন পর্যন্ত ভ্রমণটা মোটামুটি উপভোগের ছিল। দুবাই এয়ারপোর্টে প্লেন ল্যান্ড করছে আবার টেক অফ করছে আমি জানালা দিয়ে দেখছি। এরপর আমার ফ্লাইটও টেকঅফ করলো। তারপর আবার খাবার দিয়ে গেল। বেশ মজার খাবারই ছিল এবং ক্ষুধাও লেগেছিল। তো খেয়ে নিলাম। তারপর বাহিরে তাকিয়ে দেখি একদম আকাশ ছুঁয়ে মেঘের ভেলায় করে ভেসে যাচ্ছি। কিছুদূর যাওয়ার পর মেঘ দেখে মনে হলো এ যেন সাদা মেঘের বিছানা! বিমান একদম মেঘের বুকের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সূর্য এসে আছড়ে পড়ছে আমার জানালায়। আমি তবু চোখ ফেরাতে পারছি না। দেখে যাচ্ছি এক যান্ত্রিক পাখি আর মেঘের লুকোচুরি খেলা। আর আমি সেই পাখির ডানায় করে স্বচ্ছ নীল আকাশ বিচরণ করছি। আহা! কী অপূর্ব সেই দৃশ্য! ছবি তুলে ফেললাম, কিন্তু দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। তবু ফুরায় না সে দৃশ্য! প্রিয় পাঠক, আপনাদের জন্যেও এখানে আমার এই গল্পের কয়েকটা ছবি শেয়ার করছি। 



দেখতে দেখতে ডাবলিন চলে এলাম। আবার সেই মন খারাপ। মন আমার হুট করেই কেঁদে উঠে। মনে হয় আমি কোথায় চলে এলাম? কী করে এলাম? আবার কি ফিরে যেতে পারবো? কবে পারবো? আম্মুর কান্না ভেজা মুখটা মনে পড়ে কাঁদি। আজ একুশ দিন পর আমি এই গল্প লিখছি তবু চোখ আমার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।

ডাবলিন এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে ইমিগ্রেশন শেষ করলাম এবং বেল্ট থেকে লাগেজ নিলাম। তারপর বাড়িতে আম্মুর সাথে কথা বললাম। কারণ এয়ারপোর্টেই শুধু ওয়াইফাই আছে। আর আমার জন্যে শোভনী আপু সিম কিনে রেখেছে। তাই আমি আর ইমিগ্রেশন শেষ করে সিম কিনিনি। তারপর চলে এলাম বাস স্টপেজে। একটা জিনিস ভাল লাগছে একদম এয়ারপোর্ট থেকে ট্রলি নিয়ে বাস স্টপেজ পর্যন্ত যাওয়া যায়। এখানেও আগে থেকে ভাবছিলাম যে এত বড় লাগেজ, ব্যাগ নিয়ে আমি চলবো কী করে? কিন্তু সমস্যা হয়নি। তারপর ইমিগ্রেশন শেষ করতে করতে ১২ টার বাস মিস  করে ফেললাম। কারণ আমাকে ডাবলিন থেকে লিমেরিকে যেতে হবে। পরবর্তী বাস দুপুর ২ টায়। বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নাই। তো বাস স্টপেজে অপেক্ষা না করে এয়ারপোর্টের ভেতরেই ট্রলি নিয়ে অপেক্ষা করলাম। কারণ ওয়াইফাই আছে। কাজেই আম্মুর সাথে কথা বলতে পারবো। সবার সাথে যোগাযোগ করতে পারবো। দুই ঘণ্টা তো কাটাতে হবে! এরমধ্যে কিছু আর কিনে খাইনি। প্লেনে যে পরিমাণ খাবার দিয়েছিল তারই কিছু রয়েই গেছে। সেখান থেকেই একটা রুটি খেয়ে পানি খেলাম। আর আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলাম। এই করতে করতে বাস চলে এলো। সিটিলিঙ্ক দোতলা বাস। তো ড্রাইভারকে লাগেজ দিয়ে আমি একদম দোতলায় গিয়ে প্রথম সিটে বসলাম। দুই ঘণ্টার পথ ডাবলিন থেকে লিমেরিক। পথঘাট দেখতে লাগলাম। বলতেই হবে সুন্দর সবকিছু। আর আমার মত তৃতীয় বিশ্বের মানুষের কাছে তো সুন্দর লাগবেই। তো ভিউ দেখতে দেখতে যাচ্ছি, কিন্ত কিছুই চিনি না। এই হচ্ছে কথা! বাস থেকে নামবো গিয়ে আর্থার কুয়ে। সেখানে শোভনী আপু থাকবে আমাকে রিসিভ করার জন্যে। কিন্তু কোথায় সেই আর্থার কুয়ে বা কতক্ষণ পর আসবে সময় আর ফুরোয় না। অস্থিরতা থাকাটা স্বাভাবিক কারণ গত দুইদিন ধরে শুধু জার্নিই করছি। আর কত? যাক অবশেষে, গন্তব্যে পৌঁছালাম। শোভনী আপুর দেখা পেলাম। আপু অনেক আন্তরিক ছিলেন আমার সাথে। মনেই হয়নি প্রথম দেখা। সাথে উনার হাজবেন্ডও ছিলেন। এরপর উনার বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ভাত খেলাম। আপু অনেক কিছু রান্না করেছিল। শুধু তাই না সে আমাকে বক্সে করে খাবারও দিয়ে দিয়েছিলেন। চাল, চিনি, প্লেট সবই দিয়েছিলেন। আমার জন্যে কম্বল, বালিশ, সিম সবই কিনে রেখেছিলেন। এই দিনের সবকিছুই আমার সারাজীবন স্পষ্টই মনে থাকবে এবং শোভনী আপুকে ভুলে যাওয়ার কোনো উপায় নাই। উনার সাথে সেদিন আমার কিছু ছবিও আছে, কিন্তু আপুর অনুমতি ছাড়া আমার পার্সোনাল ব্লগে আপলোড করলাম না।

এরপর আমার নতুন ঠিকানায় যাওয়ার পালা। ঐ যে ১ মাসের জন্যে বাসা নিয়েছিলাম। যা শোভনী আপুর হাজবেন্ড ঠিক করে দিয়েছিল সেখানে যাব। তো শোভনী আপুর বাসা থেকে লাগেজ, ব্যাগ-ব্যাগেজ গুছিয়ে আমরা ট্যাক্সিতে উঠলাম। আজ একুশ দিন পর ঐ লোকেশন মুখস্থ হলেও সেদিন প্রথম কিছুই চিনিনি। আন্ধা মানুষের মত উনাদের সাথে ঐ বাসায় পৌঁছেছিলাম। বাসা দেখেই পছন্দ হল। সুন্দর। সমস্যা একটাই ঘরে বাইরে সব জায়গাতেই ঠাণ্ডা। এমনিতেই তো শীত প্রধান দেশ, তার ওপর এখন সারা দুনিয়াতেই শীতকাল। সেদিন ছিল নভেম্বর ১২, ২০২২। 

এই ছবিতে যে সিঁড়ি দেখতে পাচ্ছেন ঠিক এই বাসাটাই আয়ারল্যান্ডে আমার প্রথম ঠিকানা ছিল। 


আর এই বাসার ভেতরে এই সিঙ্গেল রুমটা আমার ছিল। রুমটা যেমন সুন্দর তার ভাড়াও অনেক সুন্দর (পড়ুন মারাত্মক বেশি)। 

এই ছবিটা সকাল বেলা আমার জানালা থেকে তুলেছিলাম। কী সুন্দর সূর্যোদয়! 

তো সেদিন অর্থাৎ ১২ নভেম্বর রাত আনুমানিক ৮ টায় এই বাসায় শোভনী আপু আমাকে রেখে চলে গেলেন। আমিও ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম, কিন্তু এত ক্লান্তি থাকার পরও সহজে আমি ঘুমাতে পারলাম না। অচেনা-অজানা পরিবেশ, মন খারাপ, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা সব মিলিয়েই ঘুম এলো না। তবুও কখন যেন একটু ঘুমিয়েছিলাম জানি না, কিন্তু রাত ৩ টায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। আর ঘুম এলো না। কেমন যেন আঁশফাঁস লাগছিল। রুমটাও বদ্ধ লাগছিল। মনে হচ্ছিল একটু বাইরে যেতে পারলে শান্তি লাগতো, কিন্তু সে উপায় নাই। আম্মুর সাথে কথা বললে ভালো লাগতো কিন্তু তারও উপায় নাই। অগত্যা আমাকে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। কারণ সবাই ঐ সময় ঘুমে। কাউকে বিরক্ত করা যাবে না। আয়ারল্যান্ডের বাসা বাড়িগুলা সব কাঠের। দেয়ালগুলাও কাঠের। কাজেই এক রুম থেকে কথা বললে আরেক রুমে সব শোনা যায়। আর রাতের বেলা আরও বেশি শোনা যায়। কারণ চারপাশ নীরব নিস্তব্ধ থাকে। এভাবেই আমার ১২ নভেম্বরের রাতটা কেটে গিয়েছিল এই অজানা-অচেনা শহরে। 


 

No comments

Powered by Blogger.