আয়ারল্যান্ডে ইমিগ্রেশন ইন্টার্ভিউ
আয়ারল্যান্ডে পৌঁছানোর ২/৩ দিন পরই, অর্থাৎ ১৫-ই নভেম্বর রেসিডেন্স পারমিটের জন্যে আবেদন করি। সাথে সাথেই ইমিগ্রেশন অফিস থেকে অটো রিপ্লাই দেয়। সেখানে বলা হয়েছিল, ১২ সপ্তাহ পর অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে (কাজেই নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমাতে পারেন)। তারপর দেখতে দেখতে সত্যি সত্যিই তিনমাস ছয় দিন পর সেই কাঙ্ক্ষিত ইমেইল পেলাম, অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি। ইমিগ্রেশন অ্যাপয়েন্টমেন্ট। অ্যাপয়েন্টমেন্ট তারিখটা সত্যিই মনে রাখার মত। আটাশ ফেব্রুয়ারি, দুই হাজার তেইশ। সময়- রাত ৯ঃ২০ মিনিট। হুম, সময় দেখে আমিও একটু হচকচিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু এই রাত নয়টা আসলে এখানে কেবল বেশি সন্ধ্যা (late evening)। কাজেই এইটা রাত না। এবার এইসব ভাবা বাদ দিয়ে তারা যা যা কাগজপত্র চেয়েছে তা গোছানো শুরু করলাম। যদিও হাতে সময় ছিল সপ্তাহখানেক তবুও আগে থেকেই গুছিয়েছি যাতে কোনো ভুল না করি। ওরা একটা লিস্ট করে দিয়েছিল কোন প্রফেশনের জন্যে কী কী কাগজপত্র লাগবে। সো স্টুডেন্টদের জন্যে কী কী লাগে সেটা খুঁজে বের করলাম। এখানেও স্ক্রিনশর্টটা দিয়ে দিচ্ছি।
স্ক্রিনশট তো থেকেই যাচ্ছে তবুও আমি একটু বিস্তারিত লিখব এখানে--১। ওরা যে ইমেইলটা দিয়েছে আপনাকে ঐ ইমেইলের একটা প্রিন্ট কপি অবশ্যই নিয়ে যেতে হবে। এটা সাথে না থাকলে ইমিগ্রেশন অফিসের ভেতরে যেতে দিবে না।
২। কলেজ রেজিস্ট্রেশন লেটার। এর জন্যে যেটা অবশ্যই করতে হবে সেটা হচ্ছে আপনার বর্তমান ঠিকানার সাথে রেজিস্ট্রেশন লেটারের ঠিকানা ম্যাচিং থাকতে হবে। এখানে প্রুফ অব অ্যাড্রেস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই যদি সেই তিন মাস আগে একটা লেটার নিয়েও থাকেন এবং সেই ঠিকানা যদি আপনার আগের ভাড়া বাড়ির হয় তাহলে নতুন করে আবার কলেজে আবেদন করতে হবে। আমি নিজেও তাই করেছিলাম এবং এই রেজিস্ট্রেশন লেটারের জন্যে আবেদন করলে একদিনের মধ্যেই দিয়ে দেয়।
৩। ব্যাংক স্টেটমেন্ট/ভিসা সাপোর্ট লেটার। যদি আপনি স্কলারশীপ পেয়ে থাকেন তবে ইউনিভার্সিটি থেকে আপনাকে যে ভিসা সাপোর্ট লেটার দিয়েছিল, সেটা দেখালেই হবে। অবশ্যই প্রিন্ট কপি নিতে হবে। আর ব্যাংক স্টেটমেন্টের জন্যে আপনার বর্তমান ব্যাংক স্টেটমেন্ট অর্থাৎ যে ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে আপনার পেমেন্ট যায় ঐটার স্টেটমেন্ট দেখাতে হবে।
৪। মেডিক্যাল ইন্সুরেন্স। অতি অবশ্যই লাগবে।
৫। প্রুফ অভ এড্রেস (এ এক যন্ত্রণার নাম)। খুবই অসহায় এবং মেজাজ খারাপ লাগে এই ঘোড়ার ডিমের প্রুফ অভ এড্রেসের জন্যে। এর জন্যে আপনাকে কোনো না কোনো ইউটিলিটি বিল দেখাতে হবে যেখানে আপনার নাম সহ বর্তমান ঠিকানা রয়েছে। এখন আপনি তো থাকেন ভাড়া বাড়িতে এবং শেয়ার হাউস। তো আপনি কী করে এত সহজেই নিজের নাম সহ ইলেক্ট্রিসিটির বিল, গ্যাস বিল, বা ইন্টারনেট বিলে আপনার নাম আশা করতে পারেন? কিন্তু যারা এই প্রুফ অব এড্রেস চেয়ে থাকে তারা পুরাই নাছোড়বান্দা। আপনার কোথায় থেকে কী করে ম্যানেজ করবেন সেটা আপনি জানেন। তাদের শুধু প্রুফ অভ এড্রেস চাই। তো আমি আমার প্রুফ অভ এড্রেস হিসেবে নিজের নামে কোনো বিল পেপার দেখাই নাই। আমি Personal Public Service (PPS) Number লেটার দেখিয়েছিলাম। ভাগ্যিস এইটা আগে থেকেই নিয়ে রেখেছিলাম (এই PPS লেটারটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে আরেকদিন লিখব।)। যাই হোক, নকশার আর শেষ নাই প্রুফ অভ এড্রেস।
৬। আপনি আন্ডারগ্রাডে স্টুডেন্ট হলে আপনার যাবতীয় রেজাল্ট-ট্রান্সক্রিপ্ট নিয়ে যেতে হবে। যদিও পিএইচডির জন্যে এসব দেখতে চায় না। তবুও যদি চায়, এই ভেবে আমি সব নিয়ে গিয়েছিলাম। এমন কি, আমার একটা আপডেট সিভিও নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু লাগেনি।
এইতো মোটামুটি এইসব লাগে এবং আমি সব গুছিয়ে ফেললাম। তবে অবশ্যই সব কাগজপত্র প্রিন্ট কপি নিতে হবে।
তারপর দেখতে দেখতে ২৮ ফেব্রুয়ারি চলে এলো। মনটা সেদিন খুব অস্থির ছিল আমার আম্মুর জন্যে। কারণ আম্মু অসুস্থ ছিলেন। এত দূর থেকে এই খবর শুনে কোনো সন্তানেরই ভালো থাকার কথা না। তবুও বাস্তবতা তো মানতেই হবে, না? তাই মন খারাপকে আড়াল করেই আমি ধীরে ধীরে অফিসের সব কাজ গুছিয়ে ইমিগ্রেশন ইন্টার্ভিউের জন্যে তৈরি হচ্ছিলাম। তারপর সন্ধ্যা ৬ টায় ইউনিভার্সিটি থেকে রওনা দিই। বাসে আধঘণ্টা লাগে লিমেরিক সিটি সেন্টারের ইমিগ্রেশন অফিসে পৌছাতে। তারপর সিটি সেন্টার গিয়ে কিছু খেয়ে ইমিগ্রেশন অফিসে পৌঁছালাম। তখন বড়জোর আটটা বাজে। আমি বসে আছি ওয়েটিং রুমে এমন সময় আরেকটা মেয়ে এলো। তার সাথে কথা বলতে বলতে এবং ফটোসেশন করতে করতে তার ইন্টার্ভিউের ডাক পড়লো। আমি বসে আছি একা ওয়েটিং রুমে। ইমগ্রেশন অফিসার পরের জনের নাম ধরে ডাকছিল। কিন্তু কারো সাড়া না পেয়ে সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আমি ছাড়া এখানে আর কেউ নাই নাকি? আমি বললাম, হ্যাঁ, শুধু আমিই আছি। তো আমার নাম জানতে চাইলো। বললাম। সে দেখলো আমার ইন্টার্ভিউ ৯ টা ২০ মিনিটে। তো সে এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, ওকে তুমি চলে আসো।
ইন্টার্ভিউ শুরু হলো এবং প্রথমেই আমার পাসপোর্ট চাইলেন ভদ্র মহিলা ইমিগ্রেশন অফিসার। তারপর বাকি সব ডকুমেন্টস চাইলো এবং আমি আমার ফাইলটা বাড়িয়ে দিলাম। সে সেখান থেকে ঐ যে উপরের ছয়টা ডকুমেন্টই শুধু নিয়েছে। তারপর আমার বাম হাতের ইনডেক্স ফিঙ্গারের প্রিন্ট নিল। তারপর ডান হাতের ইনডেক্স ফিঙ্গারের প্রিন্ট। এরপর বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুলের প্রিন্ট তারপর ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলের প্রিন্ট। তারপর ক্যামেরার দিকে তাকাতে বলল। আমি তাকালাম, সে আমাকে বলল, চেয়ারে একটু হেলান দিয়ে বসতে। আমি তাকে বললাম, লুকিং গুড? সে বলল, ইয়েস, পারফেক্ট। তারপর সে বলল, ৩০০ ইউরো পেমেন্ট করতে। এইটা শুধু কার্ড দিয়েই করতে হয়। নো ক্যাশ। একদম ইমেইলেই লেখা ছিল যে ক্যাশ নিবে না। তারপর পেমেন্ট শেষে সে বলল, আমার পুরা ১০ আঙ্গুলের প্রিন্ট নিবে। সো ভেতরে যেতে হবে। এইটাকেই বায়োমেট্রিক বলে আর কি! তো আমি গেলাম, কিন্তু বিপত্তি ঘটলো যখন মেশিন আমার আঙ্গুল স্ক্যান করতে পারে না। আঙ্গুল তো ঠাণ্ডায় একদম কাঠ হয়ে আছে। তো মেশিন বার বার ব্যর্থ হচ্ছে স্ক্যান করতে। শেষে ঐ ভদ্র মহিলা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে আমার সবগুলা আঙ্গুলকে চুবিয়েছে। তারপর মেশিন স্ক্যান করতে সক্ষম হয়েছিল। শেষে, ইমিগ্রেশন অফিসার হাফ ছেড়ে বাঁচলেন এবং বললেন, ওহ্! ইট ওয়াজ সো ডিফিকাল্ট। তারপর আমি আবার বাহির থেকে ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে গেলাম। সে আমাকে বলল, দুই সপ্তাহের মধ্যেই তুমি তোমার Irish Residence Permit (IRP) পেয়ে যাবে এবং তোমার নেক্সট ইন্টার্ভিউ আবার সেপ্টেম্বরে, অর্থাৎ বছরে তিনবার এই দেশের সরকারকে এরকম ৩০০ ইউরো দিতে হবে। একবার বাংলাদেশ থেকে দিয়ে এসেছি। আবার এখানে এসে দিলাম। আবার সেপ্টেম্বরে দিতে হবে। এই হচ্ছে কাহিনী!
হ্যাঁ, আমি দুই সপ্তাহের মধ্যেই আমার Irish Residence Permit (IRP) কার্ড পেয়েছি। গতকাল ১০ ই মার্চ অফিস থেকে এসে দেখি একটা খাম লেটার বক্সে রেখে গেছে। খামটা দেখেই যে কথাটা মনে মনে আওড়ালাম সেটা হচ্ছে-- আমি এখন আমার আম্মুর কাছে যেতে পারবো। প্রিয় পাঠক, এ এক নির্ভেজাল বিশুদ্ধ আবেগ মেশানো বাক্য!
খাম খুলে কার্ডটা দেখেই ভালো লেগেছিল। কারণ আমার ছবিটা ভালো এসেছে। আমি তো ভেবেছিলাম বাংলাদেশের NID কার্ডের মত গার্বেইজ টাইপের ছবি আসবে। কিন্তু না সাদাকালোর মিশেলে আঁখিকে দেখতে ভালোই লাগছে।
No comments